10 May 2024, 01:16 am

বিষ খাচ্ছি কষ্টের টাকায় — এম এ কবীর (সাংবাদিক)

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

‘ভোক্তা’ শব্দের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। ভোক্তার ইংরেজি শব্দ কনজুমার যার অর্থ ভোগকারী। অর্থাৎ কেউ কোনো পণ্য,খাদ্য,পানীয় দ্রব্য বা সেবা প্রদানকারীর সেবা গ্রহণ করে অর্থাৎ যারা ভোগ করে তাদেরকে ভোক্তা বলে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর আওতায় ভোক্তা হলেন-  “তিনিই যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন”।

ইতিহাস স্বাক্ষ্য, মানুষকে দুভাবে হত্যা করা যায়। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। প্রত্যক্ষ বলতে সরাসরি হত্যা। আর পরোক্ষ হলো কোনো মানুষের শরীরে বিষ প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। বিভিন্ন দেশে দুই ধরনের অপরাধই প্রতিনিয়ত হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষ অপরাধের জন্য আইনে মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে,পরোক্ষ অপরাধের জন্যও বিধান রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ পরোক্ষ সেই অপরাধের শাস্তির বিষয়ে অবগত নয়। জ্ঞাত নয় পরোক্ষ অপরাধ সম্পর্কেও। পরোক্ষ অপরাধ বলতে এখানে খাদ্যে ভেজাল দেয়াকে বোঝানো হয়েছে। এটা কোনোক্রমেই বিষপ্রয়োগের চেয়ে কম শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। এটা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমরা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না, প্রতিদিন আমরা যা খাচ্ছি, তা কতটা নিরাপদ। কারণ ভেজাল খাদ্যে বাজার সয়লাব। নিজের কষ্টের টাকায় আমরা মহা-আনন্দে পরিবারের জন্য বিষ কিনে নিয়ে যাচ্ছি। কারণ কোনটা ভেজালমুক্ত, তা নির্ণয় করাও কঠিন সবার জন্য। অনেকে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত, কিন্তু উদরপূর্তি তো করতে হবে। আইন থাকলেও প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের দূর্বলতার কারণে নিরূপায় জনগণ জিম্মি বিষ প্রয়োগকারীদের কাছে।

দেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (গ)-এর ১ (ঙ) ধারায় খাদ্যে এবং ওষুধে ভেজাল মেশালে বা বিক্রি করলে অপরাধীর  মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। আইনের খাতায় এমন শাস্তির বিধান থাকলেও আমরা কখনো শুনিনি খাদ্যে ভেজাল দেয়ার অপরাধে কারো মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন হয়েছে।  মাঝে মাঝে দেখা যায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ভেজালকারীকে আর্থিক দন্ড দেয়া হয়। তবে জরিমানার অঙ্কটা এতটাই কম যে, অপরাধী তাৎক্ষণিক সেই টাকা পরিশোধ করে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারও মহা-আনন্দে প্রায় দ্বিগুণ উৎসাহে ভেজাল খাদ্য বিক্রির মহোৎসবে মেতে উঠেন। ১৯৭৪ সালে সেই আইন হলেও বর্তমান সময়ে বিশেষ করে দুই যুগ ধরে এ দেশে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মাত্রা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। এবং দিন দিন তা হয়ে উঠছে সবার জন্য অসহনীয়।

আমরা প্রতিদিন যেসব ভেজাল জিনিস খাচ্ছি, তার তালিকা নেহায়েত ছোট নয়। সহজ কথায় প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কোনো না কোনো ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করছি। শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ, মসলা থেকে ফলমূল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যে যেন ভেজাল এখন অনিবার্য। কেউ যদি মনে করেন, এসব ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হলে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হবেন, সেখানেও অপেক্ষা করছে ভয়ানক বিপদ। কারণ ভেজালের তালিকায় বাদ নেই জীবন রক্ষাকারী ওষুধও। যা সাধারণ মানুষের জন্য সত্যিই ভয়ংকর। শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ না জেনে এসব কিনে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিকারের আশায়। প্রতিকার না হয়ে উল্টো ধাবিত হচ্ছে মৃত্যুকোলে। কেন এমন করছেন ভেজালকারীরা? তারা সচেতনভাবেই মূলত ফলমূল,শাকসবজি ও মাছে মেশাচ্ছেন জীবন ধ্বংসকারী বিষ ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোফেন, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার, ডিডিটিসহ নানা মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান।

তাছাড়া দেয়ালের রং, শিল্পে ব্যবহƒত রং ও লবণ, বিষাক্ত কেমিক্যাল, পোড়া মবিল, টেস্টিং সল্ট ইত্যাদির মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক খাদ্যে ব্যবহার করে আমাদের হার্ট, কিডনি, লিভার, ফুসফুসকে অকার্যকর করে দিচ্ছে। ডায়াবেটিস  এখন অতি সাধারণ রোগে পরিণত হয়েছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও প্যাথলজিক্যাল টেস্টে মানহীন ও ভেজালের ছড়াছড়ি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিহ্নিত হলেও বিচার হতে যুগের পর যুগ লেগে যায়।

এ ছাড়া বিস্কুটসহ বেকারিদ্রব্যে রয়েছে বিষসমতুল্য রং আর মুড়িতে দিচ্ছেন কৃষিকাজে ব্যবহৃত ইউরিয়া সার, যা খেয়ে আমরা ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। শিশুরা এসব খাদ্য গ্রহণ করে প্রতিনিয়ত অসুস্থ হচ্ছে। সাদা চোখে আমরা সব দেখছি। কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় জানা নেই কারও।

ভেজালকারীরা মূলত এসব কাজ করে যাচ্ছেন অধিক মুনাফা লাভের আশায়। কিন্তু তাদের লালসার কারণে অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই ভেজালের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত নয় তাদের সন্তানরাও। গত দুই দশকে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিশেষজ্ঞরা ভেজাল খাদ্য বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছে বার বার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে ভেজালজনিত বেশ কয়েকটি রোগ আমাশয়, অ্যাপেনডিক্স, রক্তচাপ, হৃদরোগ ও কিডনি রোগ আর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে।

নিরাপদ খাদ্য একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তানেও ভেজাল-নিম্নমানের পণ্য বা খাবারের আধিক্য রয়েছে। ভেজাল বলতে সাধারণত যে কোনো পণ্য বা খাদ্যে অপ্রয়োজনীয় বা অস্বাস্থ্যকর বা বিষাক্ত কোনো কিছুর মিশ্রণ যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে নিম্নমানের পণ্য সমার্থক হলেও তাতে কোনো কিছু মিশ্রণ না করেও ত্রুটিপূর্ণ উৎপাদন পদ্ধতির ফলে পণ্য বা খাদ্য মানহীন অথবা অনিরাপদ হতে পারে।

সমস্যাটি ব্রিটিশ রাজাধিরাজদের সময়ও বিদ্যমান ছিল। অতিদ্রুত অধিক মুনাফার লোভে ভেজাল পণ্য তৈরি কিংবা প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানির মানসম্মত পণ্যের নকল করে নিম্নমানের পণ্য তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে ভোক্তাকে ঠকানোর প্রবণতা রয়েছে এদের মধ্যে।

তবে প্রতিদিনই সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যথাÑ জেলা প্রশাসন,জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জাতীয় মান সংস্থা হিসেবে বিএসটিআই, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা নিম্নমানের পণ্য ও ভেজাল পণ্য বা খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুতকারী, বাজারজাতকারী ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে এবং বিপুল পরিমাণে নকল-ভেজাল পণ্য জব্দসহ ধ্বংস করছে, দায়ী ব্যক্তিদের কারাদন্ড প্রদানসহ অর্থদন্ড দেয়া হচ্ছে।

যারা পণ্যে ভেজাল মিশ্রণ করে কিংবা যারা নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করে তাদের দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই। এক সময় ফরমালিন ব্যবহারের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌছে যায় যে, মাছ, মাংস, দুধ, ফলমূল কিসে ফরমালিন মেশানো হতো না! কিন্তু ফরমালিন আইন, ২০১৩ করে সরকার এই ধরনের অপরাধীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসে, এবং ভোক্তারা যখন ফরমালিনের আশঙ্কায় ফলমূল ও মাছ-মাংস কিংবা শাকসবজি ক্রয়ে অধিকতর সচেতন হয়ে উঠেন তখন অসাধু ব্যবসায়ীরা ফরমালিন বিক্রি ও খাদ্য বস্তুতে এর ব্যবহার বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এ কারনে প্রতিরোধটা আসতে হয় ভোক্তা পর্যায় থেকে, বুঝতে হয় যিনি ব্যবসা করছেন বা কারখানায় পণ্য উৎপাদন করছেন দিনশেষে তিনিও একজন ভোক্তা। ব্যবসায়ীরা এখন আর শিল্প-কলকারখানার মালিক নয়, তারা মিডিয়া হাউজ, শেয়ার বাজার, রাজনীতি, ক্ষমতারও অংশীদার হচ্ছেন।

ভেজাল প্রতিরোধে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে: খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণের বিষয়ে জনসচেতনার অভাব। অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা অর্জনের প্রবণতা। মাঠ পর্যায় থেকে বিপণন পর্যন্ত পচনশীল পণ্য সংরক্ষণে সহজ প্রযুক্তির সংকট। সরকারের বিভিন্ন রেগুলেটরি সংস্থা এবং ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের ঘাটতি।

ভেজাল প্রতিরোধে করণীয়: প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষক, উৎপাদক ও বিপণনকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যপণ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ভোক্তাসাধারণকে সচেতন করা। মানসম্মত ও নিরাপদ পণ্যের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক প্রচার করা। সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা। পণ্য ও খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন: এড়ড়ফ গধহঁভধপঃঁৎরহম চৎধপঃরপবং (উত্তম উৎপাদন অনুশীলন), এড়ড়ফ ঐুমরবহব চৎধপঃরপবং (উত্তম স্বাস্থ্য অনুশীলন), এড়ড়ফ অমৎরপঁষঃঁৎব চৎধপঃরপবং (উত্তম কৃষি অনুশীলন) ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা। অসাধু ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচনে সরকারের রেগুলেটরি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে প্রকৃত তথ্য দিয়ে সহায়তা করা। সৎ, সচেতন, বিবেকবান, দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীদের ভেজাল প্রতিরোধে সংঘবদ্ধ হওয়া। সুলভ মূল্যে ও সহজ পদ্ধতিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে পণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

সুস্থ মানবসম্পদ একটি জাতির মূল চালিকাশক্তি। ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যগ্রহণের ফলে সমাজের একটি বিরাট অংশ ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এ কারণে দেশ একদিকে তাদের শ্রম ও মেধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি সরকারের চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়েই চলেছে।

২০১৩ সালে সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন প্রনয়ন করে। এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের কারাদন্ড আর সর্বনিম্ন ছয়মাস আর একইসঙ্গে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান আছে। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশে ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯,  ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫ রয়েছে। এসব আইনের অধীনেই আবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিধান আছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, আইনগুলোর একটা সমন্বয়ও প্রয়োজন। নয়তো একই অপরাধে শাস্তির মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হয়। শাস্তি নির্ভর করে কোন আইনে মামলা হয় তার ওপর। তবে ক্রেতা-ভোক্তাদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে সেটা আজো এক বড় প্রশ্ন। একই সাথে ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন এ প্রশ্নের উত্তরও ইতিবাচক নয়।

লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 3947
  • Total Visits: 712253
  • Total Visitors: 2
  • Total Countries: 1125

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ শুক্রবার, ১০ই মে, ২০২৪ ইং
  • ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
  • ১লা জ্বিলকদ, ১৪৪৫ হিজরী
  • এখন সময়, রাত ১:১৬

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018